দ্রুত পণ্য খালাসে ১৬ ধাপে ঘুষ

Untitled-20-5bb7c36905a7d-5c5600fed7a29

অটোমেশন প্রক্রিয়ায় ফাঁকফোকর থাকায় বন্দর থেকে পণ্য খালাস করতে চট্টগ্রাম কাস্টমসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এখনও ঘুষ দিতে হয় ১৬ ধাপে। দুটি অংশে ভাগাভাগি করেই নেওয়া হয় এ ঘুষ। পণ্য পরীক্ষার ঝামেলা এড়াতে ঘুষ দিতে হয় বন্দরের জেটি শাখায়। আবার শুল্ক্কহার ঠিক রেখে দ্রুত ছাড়পত্র নিতে দিতে হয় কাস্টম হাউসে। পণ্য আমদানির নথি অনলাইনে জমা দেওয়ার সুযোগ থাকলেও সেটি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে কাগজপত্র নিয়ে আমদানিকারক কিংবা তার প্রতিনিধিকে সশরীরে যেতে হয় অন্তত আটটি পয়েন্টে। এসব পয়েন্টে যারা থাকেন তাদের সন্তুষ্ট করতেই দিতে হয় এ ঘুষ। তবে ঘুষকে এরা কেউই ঘুষ বলেন না, বলেন ‘স্পিডমানি’। যিনি যত বেশি এই স্পিডমানি দেন, তত বেশি দ্রুতগতিতে হাঁটে তার ফাইল। কেউ দ্বিমত পোষণ করলে পণ্য শনাক্তকরণ (এইচএস) কোডের ফাঁদে ফেলে আইনি মারপ্যাঁচে আটকে রাখা হয় ফাইল।

এনবিআর ও কাস্টমস কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতেই আন্তর্জাতিক কাস্টম দিবসের অনুষ্ঠানে এ হয়রানি বন্ধে আকুতি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। চিটাগাং চেম্বার প্রেসিডেন্ট মাহবুবুল আলম বলেন, ‘চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস দেশের প্রধান রাজস্ব আদায়কারী প্রতিষ্ঠান। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে দ্রুত পণ্য খালাস করতে হলে শতভাগ সততা নিয়ে দ্রুততার সঙ্গে শুল্ক্কায়ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে হবে কাস্টমস কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। একদিন চট্টগ্রাম বন্দরের কোনো জাহাজ বেশি অপেক্ষা করলে আট থেকে ১০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ গুনতে হয় ব্যবসায়ীদের। আবার হয়রানি এড়িয়ে দ্রুত পণ্য খালাস করতে হলে খুশি রাখতে হয় তাদের। এ হয়রানির মাত্রা যত কমে আসবে তত বেশি কমবে পণ্যের পরিবহন ব্যয়।’ একই অনুষ্ঠানে কেডিএস গ্রুপের কর্ণধার খলিলুর রহমান বলেন, ‘কাস্টমস কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সততার সঙ্গে শুল্ক্কায়ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করলে উপকৃত হবে দেশের ১৬ কোটি মানুষ। কারণ পণ্য পরিবহন প্রক্রিয়ায় ব্যয় বাড়লে তার খেসারত গুনতে হয় দেশের প্রতিটি মানুষকে।’

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পণ্য খালাস প্রক্রিয়ায় এখনও ধাপে ধাপে হয়রানির শিকার হচ্ছেন তারা। হয়রানি থেকে বাঁচতে স্বনামে বক্তব্য দিতেও অস্বীকৃতি জানান তারা। কোনো কারণে প্রতিষ্ঠানের পরিচয় প্রকাশ পেলে পণ্য খালাসে তাদের হয়রানি আরও বেড়ে যাবে বলে মনে করছেন তারা। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে প্রতি মাসে শতকোটি টাকার পণ্য খালাস করা এক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক বলেন, ‘সব কাগজপত্র ঠিক থাকার পরও প্রতি কনটেইনার পণ্য শুল্ক্কায়ন করতে অন্তত ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা স্পিডমানি দিতে হয়। কোনো কারণে ডকুমেন্টে ছোটখাটো ভুল থাকলে .এ স্পিডমানির পরিমাণ বেড়ে যায় অন্তত তিনগুণ।’ আমদানিকারকের প্রতিনিধি হিসেবে কাস্টম হাউসে কাজ করা এক সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট বলেন, ‘ঘুষ ছাড়া  ফাইল নড়ে না কাস্টম হাউসে। সহকারী কমিশনার থেকে ওপরের লেভেলে ঘুষের পরিমাণ কম থাকলেও নিচের লেভেলে এটি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বন্দরের জেটি শাখা ও কাস্টম হাউসের সংশ্নিষ্ট গ্রুপেই লেনদেন হয় ঘুষের ৮০ শতাংশ অর্থ।’

পণ্য নিয়ে জাহাজ আসার পর অনলাইনে বিল অব এন্ট্রি (আগাম চালান) দাখিল করতে হয় কাস্টম হাউসের অটোমেশন সিস্টেমে। এরপর আইজিএম, ইনভয়েস, প্যাকিং লিস্ট, এলসি কপি, এলসিএ, ইন্স্যুরেন্স কপি, মেরিন পলিসি, কান্ট্রি অব অরিজিন সনদ ও বিল অব এক্সচেঞ্জের মূল কপি নিয়ে সশরীরে যেতে হয় সংশ্নিষ্ট গ্রুপের অ্যাপ্রেইজারের কাছে। এখানে যাচাই-বাছাই শেষে বন্ডের পণ্য হলে ফাইল পাঠানো হয় জেটির ওয়ান স্টপ সার্ভিস পয়েন্টে। ডেলিভারির সম্ভাব্য তারিখ নির্ধারণ করে ফাইল নিতে হয় সহকারী কমিশনারের কাছে। তিনি পণ্য পরীক্ষার জন্য কর্মকর্তা নিয়োগ দেন। এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে বিভিন্ন পয়েন্টে ঘুষ দিতে হয় এক থেকে তিন হাজার টাকা। এরপর বন্দর নিয়োজিত ইয়ার্ড ক্লার্কের সঙ্গে যোগাযোগ করে কনটেইনার খোলার অনুমতি নিতে হয়। ইয়ার্ডে থাকা এএসআই থেকে নিতে হয় সিলগালা কার্ড। এরপর কার্পেন্টার দিয়ে খোলা হয় কনটেইনার। কাস্টমস কর্মকর্তারা কনটেইনারে থাকা পণ্য পরীক্ষা করে জেটি কাস্টম থেকে দেন পরীক্ষার রিপোর্ট। এসব প্রক্রিয়ায় জেটিতে বিভিন্ন ধাপে ঘুষ দিতে হয় পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকা পর্যন্ত। কোনো কারণে পরীক্ষণে পণ্যের কান্ট্রি অব অরিজিন কিংবা এইচএস কোড নিয়ে সন্দেহ হলে ঘুষের এ টাকা বেড়ে যায় পাঁচ থেকে ছয়গুণ। জেটি থেকে পরীক্ষণ রিপোর্ট নিয়ে আবার যেতে হয় কাস্টম হাউসের সংশ্নিষ্ট গ্রুপে। সেখান থেকে ফাইল যায় বন্ড আউটপাস গ্রুপে। এরপর সহকারী কমিশনার শুল্ক্কহার নির্ধারণ করে দিলে ফাইল আবার আসে গ্রুপে। এখানে পুনরায় যাচাই-বাছাই শেষে ব্যাংকে শুল্ক্কহার জমা দিলে দেওয়া হয় পণ্য খালাসের ফাইনাল ছাড়পত্র। এসব প্রক্রিয়ার বিভিন্ন পর্যায়ে কাস্টম হাউসে দিতে হয় পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকা। কোনো কারণে ফাইলে ত্রুটি থাকলে এখানেও ঘুষের অঙ্ক বেড়ে যায় তিন থেকে পাঁচগুণ। এভাবে শুল্ক্কায়ন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপে আমদানি পণ্য খালাস করতে ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা গুনতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। অটোমেশন প্রক্রিয়া পূর্ণাঙ্গ থাকলে হয়রানির পাশাপাশি ঘুষের ধাপও অনেক কমত বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা।

এ প্রসঙ্গে আমদানিকারকদের প্রতিনিধি হিসেবে কাস্টম হাউসে কাজ করা সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক কাজী মাহমুদ ইমাম বিলু বলেন, ‘অটোমেশন সিস্টেম স্বয়ংসম্পূর্ণ হলে কাস্টম হাউসে হয়রানির পরিমাণ অনেক কমে যাবে। প্রায়শ সার্ভার স্লো থাকায় পণ্য খালাসে বিলম্ব হচ্ছে আমাদের। ম্যানুয়ালি কাগজপত্র যাচাই-বাছাই হওয়ায় থেকে যাচ্ছে ঘুষের সুযোগও।’ এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি চট্টগ্রামে আসা এনবিআরের সদস্য (শুল্ক্ক ও ভ্যাট প্রশাসন) প্রকাশ দেওয়ান বলেন, ‘পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে শুল্ক্কায়ন হলে কাজের ধাপ অনেক কমে যাবে। তবে কাউকে হয়রানি না করে দ্রুততার সঙ্গে পণ্য খালাস করতে হলে কাস্টমসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সততার ওপর নজর বাড়াতে হবে। কাস্টম হাউসকে পরিপূর্ণ অটোমেশনে আনতে কাজ করছে এনবিআর। শিগগির এর সুফল পাবেন সবাই।’ একই প্রসঙ্গে কাস্টমসের সদ্য বদলি হওয়া কমিশনার ড. একেএম নুরুজ্জামান বলেন, ‘কাস্টম হাউসকে পূর্ণাঙ্গ অটোমেশনের আওতায় আনতে কাজ করছে এনবিআর। আগে পোস্ট ক্লিয়ারেন্স অডিট সিস্টেম না থাকলেও এখন এসআইকোডা ওয়ার্ল্ড সফটওয়্যারের মাধ্যমে আমরা পণ্য খালাসের পরও নজরদারি করতে পারছি। বন্দরের সবক’টি গেটে স্ক্যানার থাকলে ভালোভাবে কার্যকর করা যাবে গ্রিন চ্যানেল। শুল্ক্কায়ন প্রক্রিয়ায় প্রযুক্তি যত বেশি যুক্ত হবে, তত বেশি দ্রুত হবে পণ্য খালাস কার্যক্রম। কমে যাবে হয়রানি। কমে যাবে দুর্নীতি ও জালিয়াতি।’

Pin It