বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক চিন্তা এবং উন্নয়ন অভিযাত্রা

image-137990-1584420410

সব অর্থেই মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ ছিল এক ধ্বংসস্তূপ। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ছিল মাত্র আট বিলিয়ন ডলার। সঞ্চয় জিডিপির ৩ শতাংশ। বিনিয়োগ ৯ শতাংশ। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার মাইনাস ১৪ শতাংশ। রাস্তাঘাট, বন্দর, রেললাইন ও সেতু বিধ্বস্ত। এক কোটি শরণার্থীর পুনর্বাসন। লাখ লাখ ঘরবাড়ি পুড়ে ছাই। ব্যাপক খাদ্য ঘাটতি। প্রকৃতি প্রতিকূল। আন্তর্জাতিক পরিবেশও (বন্ধু ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ছাড়া) অনুকূল নয়। এমনি এক চ্যালেঞ্জিং সময়ে দেশ চালানোর দায়িত্ব নেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মুক্ত স্বদেশে পা রেখেই ঘোষণা করেন, মাটি ও মানুষকে কাজে লাগিয়েই তিনি ‘শ্মশান বাংলাকে সোনার বাংলায়’ রূপান্তর করবেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনিই ছিলেন মুক্তিকামী মানুষের ভরসার কেন্দ্রবিন্দু। তাঁর আদর্শই অনুপ্রাণিত করেছে এ দেশের অগুনতি কৃষক ও সাধারণ মানুষের সন্তানদের মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য। ওই হিরণ্ময় সময়েই ঘটেছিল বঙ্গবন্ধুর আরাধ্য সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নের বিস্টেম্ফারণ। সেই স্বপ্ন তাঁকে তাড়া করেছে চিরদিন। বঙ্গবন্ধু ছাত্রজীবন থেকে সাধারণ মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে ছিলেন তৎপর। পাকিস্তানের গোয়েন্দাদের হাজার হাজার পৃষ্ঠার গোপন প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই তিনি তরুণদের সংগঠিত করতে শুরু করেছেন এ দেশের কৃষক, শ্রমিক তথা খেটে খাওয়া মানুষের খাদ্য সংকট ও অন্যান্য মোকাবেলার দাবিকে কেন্দ্র করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের জীবন চলার দাবির পক্ষে আন্দোলন করে বহিস্কৃত হন। তাই বলে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে অনুকম্পা প্রার্থনা করেননি।

আপসহীন শেখ মুজিব পরবর্তীকালে ছাত্রদের ও সাধারণ মানুষের প্রিয় নেতায় পরিণত হন ভাষা ও অন্যান্য গণমুখী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। এর পর প্রাদেশিক মন্ত্রী এবং গণপরিষদের সদস্য হিসেবে জনকল্যাণে যুগান্তকারী সব সিদ্ধান্ত নেন। আজীবন তিনি গ্রাম-গঞ্জে ঘুরে বেড়িয়েছেন এবং কৃষক-শ্রমিক-সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশা স্বচোখে দেখেছেন। এমনকি জেলে থাকা অবস্থায় গরিব-দুঃখী কারাবন্দিদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে মিশতেন ও তাদের দুঃখের তল অনুভব করার চেষ্টা করতেন। তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ এই গরিব-হিতৈষী অনুভবের দুটি জীবন্ত দলিল।

১৯৫৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের আইন পরিষদে দুঃখ করে তিনি বলেন, যে দেশের মানুষের ভাত, কাপড়, বাসস্থান, চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই, সেই দেশের গভর্নরদের মাসিক বেতনের প্রস্তাব করা হয়েছে ৬০০০ রুপি। তিনি প্রশ্ন করেন, এই বৈষম্য কি ইসলামী আদর্শ সমর্থন করে? একই সঙ্গে তিনি পরিষদে জমিদারি ও জায়গিরদারি ব্যবস্থা তুলে দেওয়ার বিপরীতে ক্ষতিপূরণের প্রস্তাবটির ঘোর বিরোধিতা করেন। এ ছাড়াও তিনি বারবার প্রশ্ন তুলেছেন, যখন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সব কর্মকাণ্ড পশ্চিম পাকিস্তানকেন্দ্রিক, যখন ওই সরকারের প্রশাসনে পূর্ব বাংলার কর্মকর্তাদের উপস্থিতি খুবই সামান্য, তখন কী করে পূর্বাঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব? সে জন্যই তিনি এক সময় দুই প্রদেশের দুই অর্থনীতির ভেতর বৈষম্য দূর করার জন্য একটি আর্থিক কমিশন চালু করার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। তাঁর দাবিমতো পূর্ব বাংলার কর্মকর্তা ও অর্থনীতিবিদদের অংশগ্রহণে একটি খসড়া আর্থিক কমিশন প্রতিবেদন তৈরি করা হলেও শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকার গ্রহণ করেনি। এসব কারণেই তিনি ছয় দফা আন্দোলন শুরু করেন। ফলে পূর্ব বাংলার অর্থনৈতিক বঞ্চনার বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এর পর বারবার কারাবরণ, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ও ঊনসত্তরের গণআন্দোলন এবং শেষ পর্যন্ত তাঁর বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠার কথা আমরা জানি। ততদিনে তাঁর মনে স্বায়ত্তশাসনের ধারণাটি আরও গভীরভাবে প্রোথিত হয়ে গেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতেই তিনি সত্তরের পরিষদের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। কার্যত সেই নির্বাচন ছিল ছয় দফার ওপর গণভোট। সেই ভোটে তাঁর দল নিরঙ্কুশভাবে বিজয়ী হয়েও ষড়যন্ত্রের কারণে সদস্যরা ঢাকায় ডাকা অধিবেশনে বসতে পারেনি। শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। আসে ৭ মার্চ। দিলেন তিনি মুক্তির ডাক। ২৫ মার্চে শুরু হয় গণহত্যা। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। স্বাধীন দেশের ক্ষমতা গ্রহণ করেই নেমে পড়েন নতুন করে অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে। সেই সংগ্রামের ধারাবাহিক বিবরণ চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন সাবেক অর্থমন্ত্রী এম সাইদুজ্জামান সম্প্রতি তাঁর এক লেখায়। ৭ অক্টোবর ২০১৮ তারিখে দৈনিক বণিকবার্তায় প্রকাশিত তাঁর লেখায় বঙ্গবন্ধু বাহাত্তরের শুরু থেকেই কীভাবে একটি যুদ্ধোত্তর দেশে গণমুখী অর্থনীতির প্রবর্তন করলেন, তার ধারাবাহিক বিবরণ তুলে ধরেছেন। লেখাটি নানা বিচারেই খুব গুরুত্বপূর্ণ। তিনি লিখেছেন, ‘১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে বঙ্গবন্ধু ব্যাংক, বীমা ও সব বৃহৎ শিল্প-কারখানাকে রাষ্ট্রীয়করণের ঘোষণা দেন এবং আরও জানান, শিল্প-কারখানার ম্যানেজমেন্ট বোর্ডে ৪০ শতাংশ শ্রমিক থাকবেন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে বিলগ্নিকরণ করা হবে, যার অনেকগুলো পরিত্যক্ত করা হয়েছে। ভূমি মালিকানার সর্বোচ্চ সীমা নির্ধারণ করে দেওয়ার ঘোষণাও দেন। স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান (যেটি সংসদে প্রথম নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর অনুমোদন করেন) যথার্থরূপে ও স্পষ্টভাবে বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক দর্শন নির্দেশিত ও প্রতিফলিত হয়েছে।’ (বণিকবার্তা, ঐ)

সাইদুজ্জামান তখন পরিকল্পনা কমিশন, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় এবং অর্থনৈতিক বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন। সে জন্য তাঁকে বঙ্গবন্ধু, প্রফেসর নুরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করতে হতো। সাইদুজ্জামান স্পষ্ট করেই জানিয়েছেন, ‘বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক দর্শনের কিছু মধ্য-দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য ছিল- প্রথমত. স্বনির্ভরতা, যতটা সম্ভব দেশের সম্পদ ব্যবহার করা; দ্বিতীয়ত. বিদেশ ও দাতাদের কাছ থেকে শর্তহীন অর্থনৈতিক সহযোগিতাকে স্বাগত জানানো এবং ক্রমান্বয়ে এ ধরনের নির্ভরতা হ্রাস করা; তৃতীয়ত. ১৯৭৪ সালের শুরুতেই বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ সীমা ২৫ লাখ থেকে বাড়িয়ে তিন কোটি টাকা করা হয়। কাজেই বেসরকারি খাতকে বঙ্গবন্ধু উপেক্ষা করেছেন, এটা কখনও বলা যাবে না।’ (ঐ) সংবিধানের প্রস্তাবনায় শোষণমুক্ত, সমাজতান্ত্রিক এক সমাজ গঠনের অঙ্গীকার করা হয়। যেখানে বলা হয়েছে- নাগরিকদের মানবাধিকার, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য ও সুবিচার নিশ্চিত করা হবে। তাছাড়া ধারা-১০ মানুষে মানুষে শোষণ নিরসন, ধারা ১৩-এ রাষ্ট্রীয়, সমবায়ী এবং ব্যক্তিমালিকানায় সম্পদের বণ্টন ব্যবস্থা করা। ১৪ ধারায় বলা হয়, খেটে খাওয়া কৃষক, শ্রমিক ও পিছিয়ে পড়া জনগণের শোষণ থেকে মুক্ত করা এবং ১৫ ধারায় পরিকল্পিত উপায়ে রাষ্ট্র উৎপাদনশীল শক্তির বিকাশ ঘটিয়ে নাগরিকদের জীবনের মান উন্নত করে খাদ্য, বস্ত্র, আবাসন, শিক্ষা ও চিকিৎসার অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। আরও বলা হয়েছে, কাজের অধিকার, নিশ্চিত কর্মসংস্থান ও মজুরির ব্যবস্থাও করবে রাষ্ট্র। এই ধারাতে আরও বলা হয়েছে যে, বেকার, অসুস্থ প্রতিবন্ধী, বিধবা, বয়স্ক ও অন্যদের সামাজিক সুরক্ষা দেওয়া হবে। ১৬ ধারাতে গ্রামীণ পর্যায়ে বিদ্যুতায়ন, কুটির শিল্প, শিক্ষা, জনস্বাস্থ্য, যোগাযোগ, শহর ও গ্রামের জীবনমানের বৈষম্য দূর করার অঙ্গীকার করা হয়েছে। ১৭ ধারাতে গণমানুষের উন্নয়নের জন্য একই ধারার শিক্ষাব্যবস্থা, আইন দ্বারা শিশুদের বাধ্যতামূলক শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। ১৮ ধারাতে বলা হয়েছে যে, পুষ্টির মান ও জনস্বাস্থ্য উন্নয়নের ব্যবস্থা করবে রাষ্ট্র। আর ১৯ ধারায় বলা আছে, নাগরিকদের সবাইকে সমান সুযোগের ব্যবস্থা করবে রাষ্ট্র।

সংবিধানের এসব অঙ্গীকার আসলে উন্নয়নের মূলধারার বিষয়। বাংলাদেশ বর্তমানে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকগুলোতে যে চোখ ধাঁধানো সাফল্য অর্জন করে চলেছে, তার গোড়াপত্তন করে গেছেন বঙ্গবন্ধু তাঁর নেতৃত্বে প্রণীত অধিকারভিত্তিক সংবিধানে ও অর্থনৈতিক পরিকল্পনায়। আমরা তাঁর সেই সামাজিক বিনিয়োগের সুফল পাচ্ছি এতদিন পরে। মাঝে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির অনীহার কারণে সাংবিধানিক এসব অঙ্গীকার সেভাবে রূপায়ণ না হলেও বঙ্গবন্ধুকন্যা সরকার পরিচালনার পুনরায় দায়িত্ব নেওয়ার পর আর্থ-সামাজিক প্রতিটি ক্ষেত্রেই লক্ষ্য করার মতো উন্নতি চোখে পড়ছে। প্রধানমন্ত্রী সাংবিধানিক ধারাগুলোর অঙ্গীকার মাথায় রেখে বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক দর্শনকে সুদৃঢ়ভাবে রূপায়ণ করে চলেছেন বলেই বাংলাদেশের উন্নয়ন ধারাটি বিশ্বজুড়ে রোল মডেল হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। আর সেই কারণেই শিশুমৃত্যু, মাতৃমৃত্যু, নারী ক্ষমতায়ন, জীবনের প্রত্যাশিত আয়ুর মতো সামাজিক সূচকের বাংলাদেশ পাশের দেশ ভারতসহ উন্নয়নশীল বিশ্বের চেয়ে অনেক ভালো অর্জনের অধিকারী হতে পেরেছে। সামাজিক সূচকগুলো ছাড়াও অর্থনৈতিক সূচকেও বাংলাদেশের অর্জন আকর্ষণীয়। জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৩-১৬ সময় পর্বে ভারতের মাথাপিছু আয় যেখানে বেড়েছে ০.১৩ শতাংশ, সেখানে বাংলাদেশে তা বেড়েছে .৩৯ শতাংশ। জিডিপি প্রবৃদ্ধির দৌড়েও গত বছর বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে এগিয়ে ছিল। মাথাপিছু আয়ের বিচারেও ২০২০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ ভারতকে ডিঙিয়ে যাবে বলে কোনো কোনো পর্যবেক্ষক দাবি করছেন।

বাংলাদেশের এই সাফল্যের পেছনে জাতি হিসেবে আমাদের সাহস, উদ্যম, সৃজনশীলতা এবং সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে কাজ করার মতো ইতিবাচক উপাদানগুলোর কথা ভুললে চলবে না। আমাদের সামাজিক উন্নয়নে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি অসংখ্য অ-সরকারি প্রতিষ্ঠানও হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করে চলেছে। সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে এই পার্টনারশিপ খুব কাজে লেগেছে। যেমন- খাবার স্যালাইন, শিশুদের টিকা প্রদান, অনানুষ্ঠানিক প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা, প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যায় কমিউনিটি হেলথ ক্লিনিক, স্যানিটারি ল্যাট্রিন ব্যবহার, সোলার বাতির ব্যবহারসহ বহুবিধ কর্মসূচির প্রভাব সামাজিক উন্নয়নের গতিকে ত্বরান্বিত করেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা চলে, মাত্র এক শতাংশ মানুষ এখন স্যানিটারি ল্যাট্রিন ব্যবহারের বাইরে আছেন। ভারতের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ এই ব্যবস্থার বাইরে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও বাড়ন্ত গার্মেন্টস খাত ৪০ লাখেরও বেশি গ্রামীণ নারীকে শুধু কর্মসংস্থানই দেয়নি, তাদের ক্ষমতায়নেও সাহায্য করেছে। ১৫ বিলিয়নের রেমিট্যান্সপ্রবাহ গ্রামে উন্নতমানের ঘরবাড়ি স্থাপন ছাড়াও পুকুরে মাছের চাষ, মুরগি ও গরুর খামারসহ নানা ধরনের আয় উৎসারণমুখী খুদে ও মাঝারি উদ্যোগ, আধুনিক কৃষি খামার, ফুলের চাষ, কুটির শিল্পের মতো নানা উদ্যোগের সূচনা করেছে। পাশাপাশি গ্রামে মোবাইল ফোনের ব্যবহার প্রায় শতভাগ। এই প্রযুক্তির হাত ধরে মোবাইল ব্যাংকিং ও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের দ্রুত প্রসার ঘটেছে। ফলে গ্রামীণ সমাজে আধুনিক অর্থ লেনদেন ব্যবস্থা চালু হয়েছে। ব্যাংকের গ্রামীণ শাখাও বেড়েছে। ফলে গ্রামীণ উদ্যোক্তার (এজেন্টসহ) সংখ্যাও ব্যাপক হারে বেড়েছে। এভাবেই গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা হচ্ছে।

অর্থনীতির এই বাড়ন্ত অবস্থা (সর্বশেষ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ৭.৮৬ শতাংশ) বাংলাদেশের অর্থনীতিকে অনেকটাই আত্মনির্ভরশীল করেছে। নিজের অর্থে পদ্মা সেতু তৈরি করার সিদ্ধান্তটি ছিল এক অসাধারণ সাহসী পদক্ষেপ। এরপর থেকে উন্নয়ন অংশীদাররাও বাংলাদেশকে সমীহ করে চলতে বাধ্য হচ্ছে। এই সাহস প্রধানমন্ত্রী দেখিয়েছিলেন দেশের অগ্রসরমান অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার (তখন আট মাসের আমদানির সমপরিমাণ বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ কেন্দ্রীয় ব্যাংকে গড়ে উঠেছিল) ওপর ভর করেই। সেই সাহস তিনি আরও অনেক ক্ষেত্রেই দেখিয়ে চলেছেন। আমার বড়ই সৌভাগ্য যে, ইতিহাসের সেই বাঁকবদলের সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে আমি তাঁর পাশে থাকতে পেরেছিলাম। এই সাহস তিনি জন্মসূত্রেই পেয়েছেন। সাইদুজ্জামান জানিয়েছেন, ১৯৭৩ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দাতাদের প্রথম বৈঠকে বাংলাদেশ স্পষ্টভাবে বলতে পেরেছিল যে, পাকিস্তানের নেওয়া বিদেশি সাহায্যের কোনো দায় নেবে না। কেননা বাংলাদেশ পাকিস্তানের কোনো উত্তরাধিকারী রাষ্ট্র নয়। বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন ভাইস প্রেসিডেন্ট পিটার কারগিল ওই সময় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এক বৈঠকে বঙ্গবন্ধুকে প্রশ্ন করেছিলেন, দাতাদের কাছ থেকে সহায়তা না নিয়ে বাংলাদেশের জনগণ কী খাবে। এম. সাইদুজ্জামান লিখেছেন, ‘বঙ্গবন্ধু পাইপ হাতে নিয়ে উঠে তাকে বললেন, ‘আমার সঙ্গে আসুন’ বলে জানালার কাছে নিয়ে গেলেন, দেখালেন এবং বললেন, ‘আপনি নিচে কী দেখতে পাচ্ছেন? আপনি বাইরে কী দেখতে পাচ্ছেন? কারগিল বললেন, ‘সবুজ ঘাসের একটি সুন্দর উঠোন।’ বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘যদি আপনারা কোনো ধরনের সহায়তা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, তবে আমার জনগণ এগুলো খাবে।’ এমনি আত্মমর্যাদাশীল এক নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু। পরবর্তী সময়ে অবশ্য অনেক শিথিল শর্তে ওই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হয়েছিল। গঠিত হয়েছিল ‘বাংলাদেশ এইড গ্রুপ’। আরও বেশি-বিদেশি সাহায্য পেতে বাংলাদেশের সমস্যা হয়নি। ঠিক যেমনটি ঘটছে এখন শেখ হাসিনার বাংলাদেশে। বিশ্বব্যাংক থেকে পদ্মা সেতু নির্মাণে ঋণ না নেওয়ার সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণে এখন আরও বেশি করে অন্যান্য খাতে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, জাইকা, এআইআইবি, আইডিবি, ডিএফআইডিসহ অনেক প্রতিষ্ঠানই। নিজের মাটিতে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা এখন তাঁর বাবার মতোই মাথা উঁচু করে বাইরের দিকে তাকান। রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় যে সৎসাহস তিনি দেখিয়েছেন, তাতে বিদেশিদের কাছে তিনি একজন সাহসী ও মানবিক রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে আদৃত হচ্ছেন।

তাই বলতে দ্বিধা নেই, বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বের পরম্পরা এমনভাবে গ্রথিত হয়ে এগোচ্ছে যে, বাংলাদেশ আজ সারাবিশ্বেই এক ‘উন্নয়নের বিস্ময়’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করছে। এই পরম্পরা বজায় থাকুক। উন্নয়নের এই অগ্রযাত্রা অক্ষুণ্ণ ও অটুট থাকুক।

ড. আতিউর রহমান

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর এবং বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ
[email protected]
Pin It